“অ দেবী তর, কেমন পা, ধূলা লাগে না
ধূলায় গড়া পুতলিইইই, ধূলা ধরে না…”
মিনার্ভা থিয়েটারের দর্শকাসনে বসে মিনার্ভা রেপার্টরির নিবেদন শ্রী মনোজ মিত্রের “দেবী সর্পমস্তা” যখন এই গানটি দিয়ে শুরু হলো, তখনও বুঝিনি পরের তিন ঘন্টায় কি ঘটতে চলেছে। মঞ্চের এক কোণে বসে কথক শুরু করল গানটি, সঙ্গে দোতারায় আর একজন। গানটার প্রথম লাইন গাওয়া হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্চে প্রবেশ করল মাদল ও ধামসা – মাতিয়ে দিল সম্পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ।
প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার মুখেই এক আলো-আধারি পরিবেশে জ্বলে থাকে প্রদীপ। দেবী সর্পমস্তার আলতা পড়া পায়ের ছাপই আমাদের পৌঁছে দেয় প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে।
“দেবী সর্পমস্তা” নাটক শুরু হতে যে কার্ডটি আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছিল, তাতে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম ছাড়াও আরও কিছু কথা লেখা ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল অনেকটা এরকম – “শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরেই প্রথম শব্দ যেমন বলে – মা, তেমনি এই নাটকের মহড়ার প্রথমদিন আমরাও বলেছিলাম – সা”। হ্যাঁ, এই সঙ্গীতময়তাই বোধহয় দেবী সর্পমস্তাকে এত অনবদ্য ও উপভোগ্য করে তোলে।
কিন্তু সঙ্গীত বাদ দিয়েও, গল্পেও কিছু কম যায় না এই নাটক। সিংহগড়ের রাজা লোকেন্দ্রপ্রতাপের পরিবারের রাজপুরোহিত প্রভাকর শর্মা একাগ্র চিত্তে পুজো করেন রাজপরিবারের দেবী সর্পমস্তাকে। সকালে ও সন্ধ্যায় আরতি করেন দেবীর। কিন্তু রাজা যখন সেনাপতির ফাঁদে পা দিয়ে দেবীর অমূল্য কন্ঠহার ইংরেজ প্রভুর মন রাখতে সাহেবের হাতে তুলে দিতে চান, তখন প্রভাকর শর্মা রুখে দাঁড়ান। তার ফলে রাজা তাকে নির্বাসন দেন। প্রভাকর শর্মা নিজের মেয়ে গৌরীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাড়ি দেন অজানার পথে, সঙ্গে নিয়ে নেন দেবীর কন্ঠহার। সেই কন্ঠহারের লোভেই তার পিছু নেয় ভাঁড় রঙ্গলাল। বহু পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে তারা এসে পৌছয় এক আদিবাসী ব্যাধদের লোকালয়ে। ব্যাধ সর্দার ডাহুকের থেকে প্রভাকর শর্মা জানতে পারেন, এই আদিবাসীদেরই দেবী ছিলেন সর্পমস্তা, যাকে লোকেন্দ্রপ্রতাপের পিতামহ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাধরা দেবীর কন্ঠহার লুঠ করতে এলে নিজের মেয়ের প্রাণ রক্ষা করতে প্রভাকর শর্মা বলেন গৌরীই দেবী সর্পমস্তা। দেবী মানব মূর্তি ধারণ করেছেন। আদিবাসীরা গৌরীকে দেবী রূপে পুজো করে।
ক্রমে গৌরী যুবতী হয়ে ওঠে। দেবী হয়ে থাকতে সে চায় না। তার মন টানে উদ্দাম ব্যাধপুত্র উদাস। ঠিক যেমন করে উদাস টানে ব্যাধ কন্যা ইচ্ছারও মন। ইচ্ছা তার ভালোবাসা প্রকাশ করে, কিন্তু গৌরী লুকিয়ে রাখে। উদাস একাই শিকার করে, হরিণ মেরে তাই দিয়ে ব্যবসা করে গৌরীর জন্য নিয়ে আসে চুড়ি। কিন্তু উদাস গৌরীকে বিয়ে করতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গৌরীর দেবীত্ব, যা গৌরী নিজে বিশ্বাস করে না। ইতিমধ্যে প্রভাকর শর্মার মৃত্যু হলে ব্যাধরা রঙ্গলালকে তাড়িয়ে দিলে সে সিংহগড়ে ফিরে গিয়ে ডেকে আনে রাজা লোকেন্দ্রপ্রতাপকে, যিনি ব্যাধদের আক্রমণ করেন না। তিনি গৌরীর থেকে কেবল একটি পুত্র চান। গৌরী ও রাজার বিবাহ স্থির হলে উদাস বিষ খায়। গৌরী বুঝতে পারে, সে রাজাকে নয়, ভালোবাসে উদাসকেই। তাকে ও উদাসকে বাঁচাতে ইচ্ছা যায় রাজার ইতিমধ্যে রাজা জানতে পারেন যে তার সেনাপতি ইংরেজের সাহায্যে রাজ্যের দখল নিয়েছে। রাজা বনবাসী ব্যাধদের কন্যাকে বিয়ে করেছেন, সেই আত্মীয়তায়ই সাহায্য ভিক্ষা চান ডাহুকের কাছে। রাজা ও প্রজা একত্রে লড়াইয়ের শপথ নেয়। রাজার অভিভাবকের মত দেওয়ান তাকে আশ্বস্ত করেন। দেওয়ানই সায়েস্তা করেন রাজার শ্যালক, সেনাপতিকে, যে রাণীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজাকে হত্যা করে রাজ্যের দখল নিতে আগ্রহী ছিল।
নাটকে রাজার ও কথকের দ্বৈত চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় ও গানে মন কেড়ে নেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য। ‘অ দেবী তর কেমন পা’, ‘কান্না কিসের ফলে’ বা অন্য যে গানই হোক্, তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর কন্ঠস্বরে মন ভরে ওঠে। এ ছাড়াও লক্ষ্যণীয় মুহূর্তে কেমন করে রাজা থেকে কথক এবং কথক থেকে আবার রাজা লোকেন্দ্রপ্রতাপ হয়ে ওঠে। রঙ্গলালের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ বর্ধন তারঁ অসাধারণ অভিনয়ে মুগ্ধ করেন। প্রভাকর শর্মার ভূমিকায় বিশ্বজিত দাস, ডাহুকের চরিত্রে লোকনাথ দে বা উদাসের ভূমিকায় কৌশিক কর-ও অনবদ্য। সঙ্গে পাওনা কিংশুকের হাতের মিষ্টি দোতারা। ছোট গৌরীর চরিত্রে যে ছোট মেয়েটি অভিনয় করল, তার প্রশংসা প্রাপ্য। এছাড়া বড় গোরী চরিত্রে অঙ্কিতা মাঝি ও ইচ্ছের চরিত্রে লোপামুদ্রা বেশ ভালো। সর্পমস্তার নাচে মামণি দাশগুপ্ত ভালো। দেওয়ানের ভূমিকায় কৌশিক অধিকারী এবং সেনাপতির ভূমিকায় সুমিত দত্ত প্রমাণ করেন যে আর যাই হোক না কেন, অভিনয় প্রতিভার অভাব তাঁদের নেই।
নাটকের শেষে বলতেই হয়, এই নাটকে পরিচালক শ্রী দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এমন অসাধারণ কাজ করেছেন, যা সমগ্র বাঙালী নাট্যপ্রেমিকে মোহিত করতে সক্ষম, গর্বিত করবে যে কোন নাট্য পরিচালককে। নৃত্য পরিচালনা ও সঙ্গীত প্রয়োগেও এই নাটক সমসাময়িক কালের অন্য বহু মঞ্চসফল প্রযোজনাকে পিছনে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাংলা নাটকের দর্শক সংখ্যায় যে ভাঁটার টান লেগেছিল, তার থেকে জনপ্রিয়তার জোয়ার আনতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে মিনার্ভা রেপার্টরির “দেবী সর্পমস্তা”।
নাটকের শেষে সব কলাকুশলী ধামসা-মাদল বাজাতে বাজাতে যখন চলে যায়, মনে তখনো সম্পূর্ণ রেশ থেকে যায়, বাজতে থাকে ‘অ দেবী তর কেমন পা, ধূলা লাগে না…”…।